কাশফ ও এলহাম সম্বন্ধে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গী কি? ক্বুরআন হাদিসের আলোকে বিস্তারিত জানাবেন।
- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আকিদা হল, কুরআন ও সুন্নাহের অনুসারী আল্লাহর ওলীদের থেকে কারামত প্রকাশিত হওয়া সত্য। সেই হিসেবে আল্লাহ তাআলা কখনো কোন প্রিয় বুজুর্গ বান্দাকে কোন বিষয়ে কাশফ করা তথা কোন বিষয় প্রকাশিত করে দেয়া বা ইলহাম করা তথা কোন বিষয় সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে থাকেন। এটিকে কাশফ ও ইলহাম বলা হয়। তবে কাশফ ও ইলহাম শরীয়তের কোন দলীল নয়। কাশফ কাশফ মানে হল অজানা কোন বিষয় নিজের কাছে প্রকাশিত হওয়া। এ কাশফ কখনো সঠিক হয় আবার কখনো মিথ্যা হয়। কখনো বাস্তবসম্মত হয়, কখনো বাস্তব পরিপন্থী হয়। তাই এটি শরীয়তের দলীলতো নয়ই, উপরন্তু এটিকে শরীয়তের কষ্টিপাথরে যাচাই করা আবশ্যক। এমনিভাবে কাশফ ইচ্ছাধীন কোন বিষয় নয় যে, তা অর্জন করা শরীয়তে কাম্য হবে বা সওয়াবের কাজ হবে। অনুরূপ কাশফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। বুযুর্গ তো দূরের কথা, মুমিন হওয়াও শর্ত নয়। কাশফ তো ইবনুস সাইয়্যাদের মাত দাজ্জালেরও হতো। সুতরাং কাশফ বুযুর্গ হওয়ার দলীল হতে পারে না। -মাওকিফুল ইসলঅম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়াররুয়া-১১-১১৪, রূহুল মাআনী-১৬/১৭-১৯, শরীয়ত ও তরীকত কা তালাযুম-১৯১-১৯২, শরীয়ত ও তরীকত-৪১৬-৪১৮, আত তাকাশশুফ আন মুহিম্মাতিত তাসাওউফ-৩৭৫-৪১৯ হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী i বলেন, “বুযুর্গদের যে কাশফ হয়ে থাকে, তা তাঁদের ক্ষমতাধীন নয়। হযরত ইয়াকুব এর ব্যাপারটি লক্ষ্য করুন। কত দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছেলে ইউসুফ এর কোন খবর তাঁর ছিল না। অথচ খবর না পাওয়ার কারণে যে কষ্ট তিনি পেয়েছেন তা সবারই জানা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যদি কাশফ ইচ্ছেধীন কোন কিছু হতো, তাহলে ইয়াকুব কেন কাশফের মাধ্যমে খবর পেলেন না? আর যখন বিষয়টি জানার সময় হল, তখন বহু মাইল দূর হতে হযরত ইউসুফ এর জমার ঘ্রাণ পর্যন্ত পেতে লাগলেন। সুতরাং কাশফ যখন কারো ইচ্ছেধীন নয়, তখন এটাও অপরিহার্য নয় যে, বুযুর্গদের সর্বদা কাশফ হতেই থাকবে। বাস্তব কথা হল, কাশফ হওয়া কোন ফযীলতের কথা নয়। এমনকি যদি কোন কাফেরও রিয়াযাত মুজাহাদা করে, তাহলে তারও কাশফ হয়ে থাকে। পাগলেরও কাশফ হয়ে থাকে। -ইলম ও আমল, বাসায়েরে হাকীমুল উম্মত-২১৫-২১৬ মাওলানা থানবী i আরো বলেন, লোকেরা কাশফ হওয়াকে বড় কৃতিত্ব মনে করে। অথচ নৈকট্য অর্জনে এর কোন ভূমিকা নেই। কাশফের সাথে কারো স্বভাবতই সম্পর্ক থাকে, কারো থাকে না। যেমন কেউ প্রকৃতিগতভাবেই দূরদর্শী হয়, আর কেউ হয় নিকটদর্শী। কাশফের সাথে কতকের স্বভাবগত সম্পর্ক থাকে না, হাজার রিয়াযাত মুজাহাদা করলেও সারা জীবনেও কাশফ হয় না। আসল জিনিস হল আল্লাহ তাআলার গোলামী। আল্লাহর কসম! যদি হাজারো কাশফ হয় এবং সে নিজের প্রতি মনোনিবেশ করে, তাহলে সে অনুভব করতে পারবে যে, অণু পরিমানও তার উন্নতি হয়নি। পক্ষান্তরে সে যদি দু’ চারবারও সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ পড়ে স্বীয় অন্তরের দিকে মনোনিবেশ করে, তাহলে পরিস্কার উপলব্ধি করতে পারবে যে, আল্লাহ তাআলার কিছু না কিছু নৈকট্য লাভ করেছে। সুষ্ঠু রুচিবানরা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। -আশরাফুস সাওয়ানেহ, বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত-২১৬-২১৭ কাশফ দলীল না হওয়ার ব্যাপারে তাসাওউফ শাস্ত্রের ইমাম শাইখ সুলাইমান দারানী i (মৃত্যু ২০৫ হিজরী) এর উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, قَالَ أَبُو سُلَيْمَانَ الدَّارَانِيُّ: رُبَّمَا يَقَعُ فِي قَلْبِي النُّكْتَةُ مِنْ نُكَتِ القَوْمِ أَيَّاماً فَلاَ أَقْبَلُ مِنْهُ إلَّا بِشَاهِدَيْنِ عَدْلَينِ الكِتَابُ وَالسُّنَّة. প্রায়ই আমার অন্তরে তাসাওউফের কোন ভেদতত্ব উদয় হয়, কিন্তু আমি তা নির্ভরযোগ্য সাক্ষীদ্বয় তথা কুরআন ও সুন্নতে রাসূল এর সাক্ষ্য ব্যতীত গ্রহণ করি না। -সিয়ারুল আলামিন নুবালা-৮/৪৭৩, বর্ণনা নং-১৫৭১ এ সম্পর্কে মুজাদ্দিসে আলফে সানী i স্বীয় পত্রাবলীতে বলেন, “ওয়াজদ ও হাল তথা তাসাওউফের বিশেষ অবস্থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়তের নিক্তিতে পরীক্ষা না করা হবে, সামান্য মূল্য দিয়েও ক্রয় করি না। অনুরূপ কাশফ ইলহামকেসমূহকে কিতাব ও সুন্নতের কষ্টিপাথরে যাচায়ের পূর্ব পর্যন্ত অর্ধ যবতূল্য হওয়াও পছন্দ করি না। -ইরশাদাতে মুজাদ্দেদে আলফে সানী-১২৪, মাকতূব নং-২০৭ ইলহাম ইলহামের পারিভাষিক অর্থ হল, চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোন কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ইলহাম কাশফেরই প্রকার বিশেষ। ইলহাম সহীহ হলে তাকে ইলমে লাদুন্নী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কথা হল ইলহামও স্বপ্নের ন্যায় কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। যে ইলহাম শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কিত নয় এবং তার বিষয়বস্তু শরীয়তপন্থী নয় বা যে ইলহাম শরীয়তের কোন হুকুম আহকাম সম্পর্কিত কিন্তু এর পক্ষে শরীয়তের দলীলও বিদ্যমান থাকে, শুধু এ ধরণের ইলহামকেই সহীহ ইলহাম বলা হবে এবং ধরা হবে এটি আল্লাহ তাআলা পক্ষ থেকে হয়েছে। এটি আল্লাহ তাআলার নিয়ামত বলে পরিগণিত হবে। এ ব্যাপারে তাঁর শোকর আদায় করা দরকার। আর যদি ইলহামে উপরোক্ত শর্তগুলো না পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেয়া হবে যে তা শয়তানের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরণের ইলহাম থেকে বিরত থাকা এবং তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক। -ফাতহুল বারী-১২/৪০৫, কিতাবুত তাবীর, বাব-১০, রূহুল মাআনী-১৬/১৬-২২, তাবসিরাতুল আদিল্লা-১/২২-২৩, মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়াররুয়া-১১-১১৪ হাদীসে এসেছে
عَنْ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ لِلشَّيْطَانِ لِمَّةً، وَلِلْمَلَكِ لِمَّةً، فَأَمَّا لِمَّةُ الشَّيْطَانِ فَإِيعَادٌ بِالشَّرِّ، وَتَكْذِيبٌ بِالْحَقِّ، وَأَمَّا لِمَّةُ الْمَلَكِ فَإِيعَادٌ بِالْخَيْرِ، وَتَصْدِيقٌ بِالْحَقِّ، فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَعْلَمْ أَنَّهُ مِنَ اللهِ، فَلْيَحْمَدِ اللهَ، وَمَنْ وَجَدَ مِنَ الْآخَرِ فَلْيَتَعَوَّذْ مِنَ الشَّيْطَانِ، ثُمَّ قَرَأَ (الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا) (البقرة: 268) নিশ্চয় মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। ফেরেশতার উদ্রেক হল, কল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি দান এবং হকের সত্যায়ন করা। যে ব্যক্তি এটি অনুভব করবে, তাকে বুঝতে হবে যে, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে, তাই তার প্রশংসা করা উচিত। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয়টি অনুভব করবে, তাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় কামনা করতে হবে। অতঃপর তিনি (সূরা বাকারার ২৬৮ নং) আয়াত পাঠ করেন, অর্থাৎ শয়তান তোমাদের অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অধিক অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। -সুনানুল কুবরা লিননাসায়ী, হাদীস নং-১০৯৮৫, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৯৯৭, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪৯৯৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৯৮৮ এ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ইলহাম কখনো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। কাজেই ইলহাম হক ও বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না এবং শরীয়তের কোন দলীল হতে পারে না। তাছাড়া আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইলহাম হওয়ার আলামত শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তা হক ও ভাল। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হক ও ভালোর মাপকাঠি হল কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা কিয়াস। ফিক্বহ ও আকাইদ বিষয়ক আইম্মায়ে কেরাম ছাড়াও হক্কানী সুফিয়ায়ে কেরাম এ কথার সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, কাশফ ও ইলহাম শরীয়তের কোন দলীল নয়। বরং শরীয়তের অন্যান্য দলীলের আলোকে কাশফ ও ইলহামের বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। পিছনে কাশফের আলোচনায় ইমাম আবূ সুলাইমান দারানী এবং মুজাদ্দেদে আলফে সানী i এর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।
وممن صرح بأن الإلهام ليس بحجة من الصوفية الإمام الشعراني وقال: قد زل في هذا الباب خلق كثير فضلوا وأضلوا، ولنا في ذلك مؤلف سميته حد الحسام في عنق من أطلق إيجاب العمل بالإلهام وهو مجلد لطيف সুফিয়ায়ে কেরামের ইমাম শায়েখ আব্দুল ওয়াহহাব শারানী i স্পষ্ট ভাষায় এ কথা বলেছেন যে, ইলহাম কোন দলীল নয়। তিনি আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে (ইলহামকে দলীল মনে করে) বহু লোকের পদস্খলন ঘটেছে। তারা নিজরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করেছে। আমি এর খন্ডনে একটি বই লিখেছি। তার নাম হল, হদ্দুল হুসান ফী উনুকি মান আতলাকা ঈযাবাল আমালি বিল ইলহাম। -তাফসীরে রূহুল মাআনী-১৬/১৭ সুফিয়ায়ে কেরামের ইমাম শায়েখ সারী সাকাতী i বলেন, من ادعى باطن علم ينقضه ظاهر حكم فهو غالط যে ব্যক্তি এমন বাতেনী ইলমের (ইলহাম) দাবী করে, যাকে যাহেরী শরীয়ত প্রত্যাখ্যান করে, সে ব্যক্তি বিরাট ভুলের মাঝে পতিত আছে। -তাফসীরে রূহুল মাআনী-১৬/১৯ ইমাম আবূ সাঈদ খাররাজ সূফী i বলেন, وقال أبو سعيد الخراز: كل فيض باطن يخالفه ظاهر فهو باطل ঐ সকল বাতেনী ফয়েজ (ইলহাম) যা যাহেরের (শরীয়তের) পরিপন্থী তা ভ্রান্ত। -তাফসীরে রূহুল মাআনী-১৬/১৯ স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে একটি সর্ববিদিত মৌলিক কথা হল, এগুলো কোনটিই ব্যক্তির ইচ্ছেধীন নয়। সম্পূর্ণই ইচ্ছেশক্তির বাইরের বিষয়। তাই এগুলো শরীয়তের ভিত্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এসব শরীয়তের কাম্য বস্তুও নয়। যদি এসব শরীয়তের কাম্য বস্তু হতো, তাহলে আল্লাহ তাআলা এসবকে মানুষের ইচ্ছেধীন বানিয়ে দিতেন। আর এসব অর্জনের জন্য নির্দেশনাও পবিত্র কুরআন ও হাদীসে। তাই এসবকে মাপতে হবে শরীয়তের দলীলের উপর মাপকাঠিতে। কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইজমা কিয়াসের আলোকে যা সমর্থনযোগ্য তা সহীহ বলে ধর্তব্য হবে। আর না হলে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হবে। তবে সর্ববস্থায় এসব দ্বারা শরীয়তের কোন বিধান সাব্যস্ত হবে না।
- والله اعلم باالصواب -